রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকেই ন্যাটো কি বা ন্যাটো প্রতিষ্ঠা কেন করা হয়েছিল তা নিয়ে সবাই আগ্রহী হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে ন্যাটো (NATO) বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন হলো একটি সামরিক জোট যা আধুনিক বিশ্বের ভূরাজনৈতিক অবস্থান গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ন্যাটোর প্রতিষ্ঠা থেকে বর্তমান পর্যন্ত এর ইতিহাস, উদ্দেশ্য এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস নিয়ে এখানে বিশদ আলোচনা করা হবে। আরো জানুন ন্যাটোর সর্বশেষ সদস্য রাষ্ট্র কোনটি ?
ন্যাটো প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যেভাবে
ন্যাটো প্রতিষ্ঠা হয়, ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল, ওয়াশিংটন ডিসিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে এবং পর্তুগাল মিলে এই সামরিক জোট গঠন করে।
এর মূল উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট চিন্তাভাবনাকে ইউরোপে বিস্তৃত হতে না দেয়া । ন্যাটোর প্রতিষ্ঠার মূল নীতিমালা হলো, এই সদস্যের কোনো রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে বাকি সদস্য রাষ্ট্রের উপর দায়িত্ব হবে যে, তারা একত্রে আক্রান্ত দেশকে সুরক্ষা করবে।
প্রথম অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ
ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পেছনে ১২টি প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্র ছিল। এগুলো হলো:
- যুক্তরাষ্ট্র
- যুক্তরাজ্য
- ফ্রান্স
- কানাডা
- বেলজিয়াম
- ডেনমার্ক
- আইসল্যান্ড
- ইতালি
- লুক্সেমবার্গ
- নেদারল্যান্ডস
- নরওয়ে
- পর্তুগাল
ন্যাটো কি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে?
প্রতিষ্ঠাকালে ন্যাটোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা ইউরোপের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব মোকাবিলা করা। ন্যাটোর যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ১২টি সদস্য নিয়ে, কিন্তু আজ এটি ৩২টি সদস্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ ন্যাটোর সদস্যপদ গ্রহণ করে। আরো জানুনঃ জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগ: কানাডার প্রধানমন্ত্রী হবে?
ন্যাটোর সর্বশেষ সদস্য রাষ্ট্র কোনটি
ন্যাটোর সর্বশেষ সদস্য রাষ্ট্র হলো ফিনল্যান্ড, যা ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যোগদান করে। ফিনল্যান্ডের সঙ্গে সুইডেনও ২০২৪ সালে ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করে। রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর এই দেশগুলো তাদের নিরপেক্ষ অবস্থান ত্যাগ করে ন্যাটোর ছায়ায় আসতে আগ্রহী হয়।
ন্যাটো সদস্য তালিকা
ন্যাটোর বর্তমান সদস্য রাষ্ট্রের তালিকা নিম্নরূপ:
- প্রতিষ্ঠাতা ১২ রাষ্ট্র
- পরবর্তী যোগদানকারী: গ্রিস, তুরস্ক, জার্মানি, স্পেন
- ১৯৯০-এর দশক থেকে বর্তমান: হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, বাল্টিক দেশসমূহ (লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া), রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, আলবেনিয়া, মন্টেনেগ্রো, উত্তর মেসিডোনিয়া
ন্যাটো ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে আগ্রহী হলেও রাশিয়া এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার এটি একটি মূল কারন। ন্যাটোর নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী নেই, তবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সংকট মোকাবিলায় সম্মিলিত সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে।
ন্যাটো সরাসরি ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ না করলেও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে অস্ত্র ও সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে। জার্মান গবেষণা সংস্থা কিয়েল ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তার জন্য ৫৯.৯ বিলিয়ন ইউরো (£৪৯.৭ বিলিয়ন) বরাদ্দ করেছে।
ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলো একই সময়ে ৫২.৬ বিলিয়ন ইউরো (£৪৩.৭ বিলিয়ন) সহায়তা প্রদান করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, তুরস্ক এবং অন্যান্য দেশ ইউক্রেনকে অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র, প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আর্টিলারি বন্দুক, ট্যাংক এবং ড্রোন সরবরাহ করেছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স দীর্ঘ-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যেমন Atacms এবং Storm Shadow/Scalp সরবরাহ করেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২৫
২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ন্যাটো বাহিনী “Steadfast Dart” নামে একটি মহড়ায় অংশ নেবে। এটি বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ায় হবে এবং নেতৃত্ব দেবে যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনী। এই মহড়ায় শত্রুর আক্রমণের আগে সীমান্ত রক্ষা করার প্রস্তুতি নেওয়া হবে।২০২৩ সালে ন্যাটো পরিকল্পনা করে, যদি রাশিয়া আক্রমণ করে, তাহলে আর্কটিক, উত্তর আটলান্টিক, পূর্ব ইউরোপ বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে কীভাবে প্রতিরক্ষা করা হবে। এজন্য তারা ইউরোপে সেনাবাহিনীর সংখ্যা ৪০,০০০ থেকে বাড়িয়ে ৩,০০,০০০ করেছে এবং রাশিয়ার সীমান্তে প্রতিরক্ষা আরও শক্তিশালী করেছে।
ন্যাটোর বাজেট
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের জাতীয় আয়ের ৫% প্রতিরক্ষার জন্য ব্যয় করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই হার ন্যাটোর বর্তমান নির্ধারিত ২% লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট্টে সম্প্রতি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে একটি নতুন “যুদ্ধকালীন মানসিকতা”র অংশ হিসেবে সামরিক ব্যয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
FAQ: সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর
ন্যাটো কী?
ন্যাটো হলো একটি সামরিক জোট যা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
ন্যাটো প্রতিষ্ঠা কে করেছিল?
১৯৪৯ সালে ১২টি দেশ মিলে ন্যাটো প্রতিষ্ঠা করে।
ন্যাটোর সর্বশেষ সদস্য কোন দেশ?
ন্যাটোর সর্বশেষ সদস্য হলো ফিনল্যান্ড (২০২৩) এবং সুইডেন (২০২৪)।
ন্যাটো কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত প্রতিরক্ষার জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম।
ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেনি কেন?
রাশিয়ার আপত্তি এবং যুদ্ধ চলমান থাকার কারণে ইউক্রেনকে এখনো সদস্য করা হয়নি।